একটা ব্যবসায়ের সঠিক আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা জানার জন্য সঠিকভাবে অবচয় বা Depreciation নির্ণয় করা খুবই জরুরি। আজকের আর্টিকেলে আমরা আমরা Depreciation কী এবং তা নির্ণয়ের পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। এছাড়াও এ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেবো।
বিজনেসে Depreciation কি?
একটি সম্পত্তির ক্রয়মূল্য বা অর্জনমূল্যকে সম্পত্তিটির ব্যবহারযোগ্য জীবনকালের মধ্যে ব্যয় হিসেবে বন্টন করা হলে উক্ত ব্যয়কে Depreciation বা অবচয় বলে। এক্ষেত্রে বলা যায়, Depreciation একটি মূলধনী ব্যয় বন্টন প্রক্রিয়া।
Depreciation চার্জ করার কারণ কি?
Depreciation নির্ণয় করা হয় মূলত ব্যবসায়ের কোনো হিসাবকালের সঠিক আর্থিক ফলাফল জানা ও নির্দিষ্ট সময়ের সম্পদের প্রকৃত মূল্য পরিমাপ করার জন্য।
ধরা যাক, এবছর একটি কোম্পানি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ২০,০০,০০০ টাকা মূল্যে একটি ট্রাক কিনলো, যার অনুমিত ব্যবহারযোগ্য আয়ুষ্কাল ১০ বছর। তবে চলতি বছরেই ট্রাক ক্রয়ের সম্পূর্ণ মূল্যকে যদি ব্যয় হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং বাকি বছরগুলোতে কোনো ব্যয় লিপিবদ্ধ না করা না হয় তাহলে চলতি বছরের ব্যয় অনেক বেশি দেখানো হবে এবং প্রকৃত মুনাফা কম দেখানো হবে, যা এটি হিসাববিজ্ঞানের নিয়ম পরিপন্থী।
এই ব্যবহারযোগ্য আয়ুষ্কালের মধ্যে ট্রাকটির ক্রয়মূল্য বন্টন করাই হলো অবচয়, সরলরৈখিক পদ্ধতিতে যার প্রতিবছরের অবচয় (২০,০০,০০০÷১০) =২ ০০,০০০ টাকা। হিসাববিজ্ঞানের চলমান ব্যবসায় ধারণা এবং মিলকরণ নীতি অনুযায়ী এই Depreciation ধার্য করা হয়।
যে Assets গুলো Depreciate করা যাবে
সাধারণত, যেসব সম্পত্তি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যাবে এবং ক্রমাগত ক্ষয় পেতে থাকবে অর্থাৎ স্থায়ী সম্পত্তির ওপর Depreciation ধার্য্য করা হয়। উদাহরণসরূপ-
- দালানকোঠা (ভূমি ব্যতিত)
- কারখানার যন্ত্রপাতি
- আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি
- ইজারা সম্পত্তি ইত্যাদি
যে Assets গুলো Depreciate করা যাবে না
আসলে সকল স্থায়ী সম্পদের উপরেই Depreciation ধার্য্য করা যায় না। IFRS নীতিমালা মেনে তবেই তা করতে হয়। অবচয় ধার্য্য করা যায় না এমন কিছু সম্পদের উদাহরণ হলো-
- ভূমি
- দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ
- চলতি সম্পদ
- ব্যক্তিগত সম্পত্তি ইত্যাদি
কখন থেকে Depreciation ক্যালকুলেট করা শুরু করবো?
হিসাববিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে স্থায়ী সম্পত্তিটি ব্যবহার উপযোগী হওয়ার সময় থেকেই Deprecation ক্যালকুলেট করতে হয়। এক্ষেত্রে সম্পত্তি কেনার তারিখ বিবেচ্য নয়, বরং ব্যবহার উপযোগী হওয়ার তারিখ বিবেচিত হবে।
উদাহরণস্বরূপ- একটা প্রতিষ্ঠান ১লা জানুয়ারি, ২০২২ তারিখে একটি মেশিন ক্রয় করে। যেটি ব্যবস্যায়ে উৎপাদনের জন্য ১লা ফেব্রুয়ারিতে কারখানায় সংস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে মেশিনটির অবচয় ১লা জানুয়ারি নয়, ১লা ফেব্রুয়ারি হতে গণনা করতে হবে।
কখন Depreciation ক্যালকুলেট করা বন্ধ রাখতে হবে?
একটা সম্পত্তির ব্যবহারিক জীবনকাল শেষ হলে সম্পত্তিটির ওপর অবচয় ধার্য বন্ধ রাখতে হবে। কারণ জীবনকাল শেষে সম্পত্তিটি আর ব্যবসায়ের কাজে লাগে না। সম্পত্তিটি তখন বিক্রয় করে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী থেকে শূন্য করে দেওয়া হয়।
Depreciation চার্জের সাধারণ নিয়মাবলি
কত দ্রুত Depreciation চার্জ করতে হবে সেটার জন্য কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। তবে একটা বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে যে, Depreciation এর বাৎসরিক পরিমান এমন হোক যেটার সমষ্টি আয়ুষ্কালের মধ্যে পুরো সম্পত্তির মূল্য হয়ে ওঠে আসে। যেমন -একটি ফার্ণিচারের মূল্য ১০০০০০ যার আয়ুষ্কাল ৫ বছর। এক্ষেত্রে যদি প্রতিবছরের অবচয় ২০০০০ টাকা হয়, তবে আগামী ৫ বছর পরে মোট মেশিনের মূল্য উঠে আসবে।
অবচয় চার্জের সময় অবচয় চার্জের ধরণ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। যেমন গত বছর একরকম পদ্ধতিতে অবচয় ধার্য করলেন, অন্য বছর অন্য রকম পদ্ধতিতে। এতে যথার্থভাবে মূল্যায়ন হবে না। কারণ অবচয় চার্জের পদ্ধতি হেরফের হলে প্রতিষ্ঠানের নিট লাভ/ক্ষতির পরিমাণও হেরফের হয়। তখন প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা পরিমাপ করতে অসুবিধা হয়।
অবচয়ের পরিমাণ এমন হওয়া উচিত না যার আয়ুষ্কাল পর্যন্ত সমষ্টি করলে সম্পত্তির ক্রয়মূল্য হতে বেশি হয়।
Depreciation ক্যালকুলেট করার জন্য প্রধান বিষয়গুলো কী কী?
Depreciation ক্যালকুলেট করতে বেশকিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে হয় এবং বিবেচনায় আনতে হয়। যেমন-
- সম্পাত্তির অর্জনমূল্য: সম্পত্তি ক্রয় থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নিয়ে আসা এবং ব্যবহার উপযোগী করতে যেসকল খরচ হয় তাদের সমষ্টিই হলো সম্পত্তির অর্জনমূল্য (Cost of Asset)। যেমন- একটি কোম্পানি ৫০০০০ টাকা দিয়ে একটি মেশিন ক্রয় করে, যার পরিবহন ব্যয় ১০০০০ টাকা, সংস্থাপন ব্যয় ৫০০০ টাকা। এক্ষেত্রে সম্পত্তিটির অর্জনমূল্য বা ক্রয়মূল্য হবে (৫০০০০+১০০০০+৫০০০) =৬৫০০০ টাকা।
- আয়ুষ্কাল: একটি সম্পত্তির আনুমানিক একটি আয়ুষ্কাল ধরা হয় যে ওই সময় পর্যন্ত সম্পত্তিটি কার্যকর থাকবে। যে সময়কালটি অবচয় নির্ণয়ে খুবই গুরত্বপূর্ণ।
- ভগ্নাবশেষ মূল্য / Scrap Value: একটি সম্পত্তির আয়ুকাল শেষে সম্পত্তিটি বিক্রি করে যে অবশিষ্টাংশ মূল্য পাওয়া যায় সেটাই হলো ভগ্নাবশেষ মূল্য যাকে ইংরেজিতে বলে Salvage value।
- অবচয়যোগ্য মূল্য: একটি সম্পত্তির ক্রয়মূল্য থেকে ভগ্নাবশেষ মূল্য বাদ দিলে যে মূল্য পাওয়া যায় সেটিই হলো সম্পত্তিটির অবচয়যোগ্য মূল্য। অবচয় ধার্য্যের সরলরৈখিক ও উৎপাদন একক পদ্ধিতে এই মূল্যকে অবচয় ধার্যের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে যেক্ষেত্রে ভগ্নাবশেষ মূল্য থাকে না, সেক্ষেত্রে সম্পত্তির ক্রয়মূল্যই অবচয়যোগ্য মূল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
- সম্পত্তির বইমূল্য: সম্পত্তির অর্জনমূল্য থেকে প্রতি হিসাবকাল শেষে পুঞ্জীভূত অবচয় বাদ দিলে যে মূল্য পাওয়া যায় তাকে সম্পত্তির বই মূল্য (Book value) বলে। ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে অবচয় নির্ণয় করতে আবশ্যকীয় ২টি উপাদানের মধ্যে সম্পত্তির বইমূল্য একটি।
Depreciation ক্যালকুলেশনসহ ফিক্সড অ্যাসেট এর সম্পূর্ণ ম্যানেজমেন্ট ও রিপোর্টিং শিখতে, অর্থাৎ IAS 16 তে এক্সপার্ট হতে আমাদের IAS & IFRS সম্পর্কিত কোর্সগুলো করতে পারেন।
IAS & IFRS সম্পর্কিত কোর্সগুলো দেখতে এবং এনরোল করতে এই লিংক ক্লিক করুন।
IAS-16 Depreciation এর কোন পদ্ধতিগুলো সমর্থন করে
স্থায়ী সম্পত্তির ওপর অবচয় ধার্য করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। তবে IAS-16 এর ৬২ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে অবচয় ধার্যের প্রধানত ৩টি পদ্ধতি আছে। সেগুলো হলো-
১. সরলরৈখিক পদ্ধতি (Straight-line Method)
অবচয় ধার্য্যের সরলরৈখিক পদ্ধতিতে সম্পত্তির অবচয়যোগ্য মূল্যকে এর মোট ব্যবহারিক জীবনকালের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে প্রতিবছর সমান হারে অবচয় ধার্য করা হয় এবং অন্যসকল পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতিতে ১ম বছরে অবচয় সবচেয়ে কম থাকে। সরলরৈখিক পদ্ধতিতে সম্পত্তির ভগ্নাবশেষ মূল্য বিবেচনা করা হয়।
এ পদ্ধতিতে কীভাবে অবচয় নির্ণয় করতে হয় তা উদাহরণসহ বুঝতে নিচের ছবিটি খেয়াল করুন।
Source: embroker.com
২. ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতি (Reducing Method)
যে পদ্ধতিতে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় চলতি বছরে কম অবচয় ধার্য করা হয় তাকে ক্রমহ্রাসমান জের পদ্ধতি বলে। এ পদ্ধতিতে ভগ্নাবশেষ মূল্য বিবেচনা করা হয় না। প্রতিবছর সম্পত্তির বইমূল্যের উপরে নির্দিষ্ট হারে অবচয় ধার্য্য করা হয়। এজন্য অবচয়ের হার অবশ্যই প্রয়োজন।
এ পদ্ধতিতে অবচয়ের পরিমাণ প্রতিবছর ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে এবং এর হ্রাসের হার এবং অবচয়ের হার সমান। এ পদ্ধতিতে অবচয় নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে নিচের ছবিটি খেয়াল করুন।
Source: double-entry-bookkeeping.com
Source: double-entry-bookkeeping.com
৩. উৎপাদন একক পদ্ধতি (Production Unit Method)
এ পদ্ধতিতে সম্পত্তির প্রত্যাশিত মোট কাজের ক্ষমতার এককের ভিত্তিতে অবচয় ধার্য করা হয়। প্রতিবছর কী পরিমাণ পণ্য বা সেবা উৎপাদন করা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে অবচয় নির্ণয় করা হয়।
উদাহরণসহ বিস্তারিত বুঝতে নিচের ছবিটি ভালোভাবে খেয়াল করুন।
Source: slideplayer.com
Depreciation কি একটি Expense?
হিসাববিজ্ঞানের চলমান প্রতিষ্ঠান ধারণা ও মিলকরণ নীতি অনুযায়ী অবচয় ধার্য করা হয়। সম্পত্তির ক্রয়মূল্যকে এর জীবনকালের মধ্যে বন্টন করা হয় অবচয় নামক একটি হিসাবের মাধ্যমে, যেটাকে হিসাববিজ্ঞান একটি ব্যয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বিবরণীতে ব্যয় হিসেবে লিপিবদ্ধ করে আর্থিক ফলাফল নির্ণয় করা হয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
অবচয় নির্ণয়ের সাথে সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হলো যা আপনার জেনে রাখা উচিত।
- সম্পত্তির বইমূল্য (Book Value) হলো এর অর্জনমূল্য থেকে পুঞ্জীভূত অবচয় (Accumulated Depreciation) বাদ মূল্য এবং কোম্পানির ব্যালেন্স শীটে বইমূল্যে সম্পত্তি লিপিবদ্ধ করা হয়।
- পুঞ্জীভূত অবচয় কখনও সম্পত্তির মোট অবচয়যোগ্য মূল্যের বেশি হতে পারবে না। সম্পত্তির ব্যবহারিক জীবনকাল শেষে এই দুটির পরিমাণ অবশ্যই সমান হবে।
- একটি সম্পত্তি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ার পরেও সেটা বিক্রি করে যে পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করা যায় থাকে সম্পত্তির ভগ্নাবশেষ মূল্য বা Salvage Value বলে। এটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটা মূলধনী আয় বা \Capital Receipt.
সারসংক্ষেপ
অবচয় বা Depreciation নির্ণয় করা একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট এর অন্যতম কাজ। সঠিকভাবে তা নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে ব্যবসায়ের প্রকৃত আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা যেমন ভিন্ন হয় তেমনি কর প্রদানেও গড়মিল তৈরি হয়। এজন্য সঠিকভাবে Depreciation নির্ণয় করতে জানা খুবই জরুরি।
আশা করছি, এই আর্টিকেলের মাধ্যমে Depreciation সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পেরেছি এবং নির্ণয়ের পদ্ধতিগুলো সম্পর্কেও জানাতে পেরেছি। সময় নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
Write a public review